বীরশ্রেষ্ট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শহীদ মতিউর রহমান

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শহীদ মতিউর রহমান (২৯ অক্টোবর ১৯৪১ ; ঢাকা – ২০ আগস্ট ১৯৭১; থাট্টা)

মোঃ আব্দুল ওয়াহেদ 
নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। 

ادهر سو رہا ہے ایک غدار 
(ইধার শো রাহা হে এক গাদ্দার - অর্থঃ এখানে একজন বিশ্বাস ঘাতক ঘুমাচ্ছে। 

হ্যাঁ, করাচির একটি কবরস্থানের প্রস্তর ফলকে  লিখা ছিলো এটি। সরকারের স্বার্থে হানা দিয়ে দেশীয় সম্পদ ছিনতায়ের অভিযোগে  মৃত ব্যক্তির কবরে শীলা ফলকে লিখে দেওয়া হয়েছিলো এই বাক্য টি....

মতিউর রহমানের করাচি কবরস্থান 

কবরটি কার? আর কেনোই বা এমনটা করা হলো? বলবো তার সবকিছু। 

কবরটিতে সুয়ে আছেন বাংলার সূর্যসন্তান বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শহীদ মতিউর রহমান (২৯ অক্টোবর ১৯৪১ ;ঢাকা – ২০ আগস্ট ১৯৭১; থাট্টা)। তিনি পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর উচ্চ পদস্থ একজন পাইলট ছিলেন। 

১৯৭০ এর নির্বাচন কে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে পহেলা জানুয়ারি, ১৯৭১ এ ২ মাসের ছুটি নিয়ে চলে আসেন নিজ গ্রামে। মার্চ ০১, '৭১ এ ফিরার কথা থাকলেও দেশের প্রতি মমত্ববোধের টানে যেতে পারেন নি। এর মাঝেই নিজ গ্রামে সাধারণ মানুষ দের প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। অবশেষে মে ০৯, ১৯৭১ এ ফিরেন নিজ কর্মস্থলে। ফিরতে দেড়ি হওয়ার কারণ দর্শিয়ে যোগ দেন আপন কর্মে। 

জুন ২২, '৬৩ তে ৩৬ তম GD(P) কোর্সে নিয়োগ প্রাপ্ত অফিসার গণ
(ডান থেকে দ্বিতীয়তে বসা অবস্থায় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান)

উদ্দেশ্য ছিলো বিমান দখল করা। কয়েকজন বাঙালী সহকর্মীর সাথে আলোচনা করে ঠিক করেন  তাঁর শিষ্য রশিদ মিনহাজ কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কালে দখল করবেন T-33 মডেলের বিমান টি। ২০ আগস্ট, ১৯৭১, উড্ডয়নের অনুমতি পেয়ে রশিদ মিনহাজ উড্ডয়ন যাত্রা আরম্ভ করলেও  বিমান থামানোর নির্দেশ দেন মতিউর রহমান৷ মতিউর রহমান ছিলেন রশিদ মিনহাজের প্রশিক্ষক এবং নিরাপত্তা অফিসার। তাই বাধ্য হয়েই বিমান থামান রশিদ মিনহাজ। 

পাইলট রশিদ মিনহাজ 
এদিকে মতিউর রহমানের বিমানের পাখায় লাফ দিয়ে ঢুকে পরেন বিমানে এবং রশিদের পেছনের সিটটিতে বসে পড়েন। হঠাৎ ই পেছন থেকে রশিদের মাস্ক খুলে ক্লোরোফর্মে ভেজা রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরেন রশিদের। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। ককপিটেই শুরু হয় হাতাহাতি। 

কোনো রকমে আধ মরা অবস্থায় অজ্ঞান করে  রশিদ কে বিমানের পেছন দিকে ফেলে রেখে শুরু করেন উড্ডয়ন। এদিকে ধস্তাধস্তির আঁচ পেয়ে যায় বিমানের কনট্রোল রুম। চারটি যুদ্ধ বিমান নিয়ে ধাওয়া শুরু করে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী। 

মতিউর রহমান কৌশলে এগোতে থাকেন ভারতের উদ্দেশ্যে। মস্ত এক বিমান নিয়ে উড়ে যেতে থাকেন খুব নিঁচু দিয়ে যাতে রাডারে বিমানের অবস্থান ধরা না পরে।  T-33 বিমানের পাইলট সিট টা একটু নিঁচু হয় যাতে করে পথের স্পষ্ট দর্শন পেতে উঁচু দিয়ে উড়তে হয়। কিন্তু দক্ষ মতিউর নিঁচু দিয়েই চললেন অনেক টা ঝুঁকিপূর্ণ ভাবেই।

বিমান বাহিনীতে দায়িত্বরত অবস্থায় মতিউর রহমান

রাডারে মতিউরের বিমান ধরা না পড়ায় দিশেহারা হয়ে আকাশে উড়তে থাকে পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমান গুলো। মতিউর যখন তাঁর গন্তব্য থেকে ৫০/৬০ মাইল দূরে, ঠিক এই সময়েই ক্লোরোফর্মের ঘোর কাটিয়ে উঠেন রশিদ মিনহাজ। 

বিমানের কনট্রোল রুম এবং রশিদ মিনহাজের মধ্যে একে একে তথ্য বিনিময় হতে থাকে। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। ধাস্তধস্তির পাশাপাশি বিমান পরিচালনাও করতে হচ্ছিল মতিউর কে। এসময় বিমানের ক্যানোবি খুলে আঘাত হানে লেজে৷ বিমান হারিয়ে ফেলে তার নিয়ন্ত্রণ। 

ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে কনট্রোল রুমের নির্দেশনা মোতাবেক ইজেক্ট বাটন চাঁপার চেষ্টা করতে থাকেন রশিদ মিনহাজ এবং এক পর্যায়ে সফলও হয়ে যান। অবশেষে গন্তব্য থেকে আর মাত্র তিন মিনিটের রাস্তা দূরে ঠাট্টা নামক স্থানের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ২০ আগস্ট ১৯৭১, বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মিনহাজ রশিদের দেহ। 

সেই সাথে একজন দেশপ্রেমিকের লড়াকু চেষ্টার পরিসমাপ্তি ঘটে। বিমান ছিটকে পড়েন মতিউর রহমান। তার কাছে ছিলো না কোনো প্যারাসুট। পরে বিমান টি বিধ্বস্ত হওয়ার আধা মাইল দূরে পাওয়া যায় মতিউর রহমানের নিথর দেহ।

মহান এই দেশপ্রেমিক এর মৃতদেহ উদ্ধার করে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এবং করব দেয়  করাচির মাসরুর শহরের চতুর্থ শ্রেণির একটি কবরস্থানে। বিমান বাহিনীর একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে অত্যন্ত অমর্যাদার সাথে দাফন করা হয়। আর কবরের প্রস্তর ফলকে লিখে দেওয়া হয়
. ادهر سو رہا ہے ایک غدار 

Karachi, 1994. Visiting motiurs buried 

১৯৯৪ সালে মতিউর রহমানের কন্যা মাহিম মতিউর খন্দকার স্বীয় স্বামী এবং সন্তান সহ করাচিতে তাঁর পিতার কবর পরিদর্শন করেন। 

ডিসেম্বর ১৫, ১৯৭৩ এ বাংলাদেশ গেজেটে আত্মত্যাগ আর চরম সাহসিকতার স্বীকৃতি স্বরূপ মতিউর রহমান কে "বীরশ্রেষ্ঠ" উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে তিনি এক দেশের দেওয়া গাদ্দার উপাধি থেকে স্বদেশের সূর্যসন্তানে পরিণত হন।

বীরশ্রেষ্ঠ পদক 

পরবর্তী তে ২০০৬ সনের ২৪ জুন মতিউরের দেহাবশেষ প্রায় ৩৫ বছর পর স্বদেশে আনা হয়। 

বীরশ্রেষ্ট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শহীদ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ 

জুন ২৫, ২০০৬ এ রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় ঢাকার বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে মহান এই দেশপ্রেমিকের দেহাবশেষ সমাহিত করা হয়।  

 বীরশ্রেষ্ট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শহীদ মতিউর রহমানের কবর

একটি বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে  রশিদ মিনহাজ এবং মতিউর রহমান একই সাথে শহিদ হলেও মতিউর কে দাফন করা হয় চতুর্থ শ্রেণির একটি কবরস্থানে। আর মিনহাজ রশিদের ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া দেহ সমাহিত করা হয় রাষ্ট্রীয় বীরের খেতাবে। 
রশিদ মিনহাজের কবর 

রশিদ মিনহাজ কে পাকিস্তানের বীর হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাঁকে পাক সরকার  Nishan-e-Haider ( نشان حید ر, meaning 'Mark of the Lion') উপাধিতে ভূষিত করেছে।

অন্য দিকে মতিউর রহমানকে তারা আজও বিশ্বাসঘাতক
 ( غدار) এবং ছিনতাইকারী (Hijacker) হিসেবে অভিহিত করে। পাকিস্তানি মিডিয়া গুলো মতিউর রহমান কে জাতীয় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তুলে ধরে। 

প্রতিবছর তাঁরা রশিদ মিনহাজের স্মরণে ২০ আগস্ট তাঁর কবরস্থানে সম্মান জানায় এবং নতুন প্রজন্মের কাছে দেশপ্রেমের নমুনা তুলে ধরে।  

বাঙালীরা সেই বিশ্বাসঘাতক মতিউর রহমানকে জাতির সূর্যসন্তান হিসেবে স্মরণ করে কারণ বাঙালিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মহান এই বীর নিজের জীবন আত্মৎসর্গ করেছেন।
 
মতিউর রহমানের দেহ দেশে আনার দাবি

একই দশায় মৃত্যু, অথচ  উভয় জাতির কাছে একজন  বরণীয় এবং অপরজন শত্রু। বাঙালির কাছে তাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান চিরস্মরণীয় এবং রশিদ মিনহাজ শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়, অপরদিকে পাকিস্তানী জনগোষ্ঠী তাদের বীরসিংহ রশিদ মিনহাজ কে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে আর মতিউর রহমানকে গাদ্দার হিসেবে বিবেচনা করে। 

পরিবেশের সাপেক্ষে যে যাই হোক না কেনো, দুজনের মাঝেই একই চেতনার উন্মেষ দেখা যায়, সেটি হলো দেশপ্রেম।  বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান তার দেশের জন্য বিমান দখলের চেষ্টা করেন এবং রশিদ মিনহাজ তার দেশের সম্পদ কে লুটের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন।

উভয়েই দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আদর্শ। তবে বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা কখনোই রশিদ মিনহাজের আদর্শকে গ্রহণ করতে পারি না। আমরা আমাদের বীর কে অনুসরণ করবো। আমাদের বীর কে সম্মান দেবো। যিনি আমাদের সম্মান আর অধিকার রক্ষায় নিজের জীবন বাজি রেখেছেন আমরাও তাঁকে সম্মান করবো৷ তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দেশকে ভালোবাসবো। দেশের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবো। 


©️লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত।