প্রসঙ্গ সাহিত্য ও বিজ্ঞান
ছবিঃ প্রসঙ্গ সাহিত্য ও বিজ্ঞান কভার ফটো


প্রসঙ্গ সাহিত্য ও বিজ্ঞান


মানব যেকাল থাকিয়া আপনাকে প্রশ্ন করিতে শিখিলো সম্ভবত সেকাল থাকিয়াই বিজ্ঞান যাত্রা আরম্ভ করিয়াছিলো। প্রাকৃতিক ঘটনাসমূহ যখন একে একে মানব মনে চিন্তার বিস্তর উদ্রেক ঘটাইতে সমর্থ হইলো তখন থাকিয়া মানব ভাবিয়া চলিয়াছে উহার কারণ। প্রাকৃতিক ঘটনা সমূহ পর্যায়ক্রমে একের পর এক কিভাবে ঘটিয়া চলিয়াছে উহার সদুত্তর খুঁজিতে মানব চালাইয়া যাইতে থাকিলো একতরফা জিজ্ঞাসা। কখনো একটি ধারণার উপর জাঁকিয়া বসিয়া পুনর্বার জিজ্ঞাসা চালাইয়া যাইতে থাকিলো, আবার কখনো তাহা হইতে সামান্য সরিয়া নব্য আরেক ধারণা ধরিয়া অনুসন্ধিৎসু চিত্তে জিজ্ঞাসা অব্যহত রাখিলো। 


আর যখন থাকিয়া ধারণার সহিত উত্তর মিলিয়া যাইতে লাগিলো, সম্ভবত তখন থাকিয়া মানব কল্পনা করিতে শিখিলো। ইহাই কি তবে সাহিত্য যুগের প্রারম্ভ? মোদের প্রান্তিক চিন্তায় ইহাকেই সাহিত্য যুগের সূচনা বলিয়া মনে হইলেও সাহিত্য যুগ সম্ভবত আরও পরে শুরু হইয়াছিলো, যখন মানব কল্পনাকে শিল্পরূপে উপস্থাপন করিতে শিখিলো। সাহিত্য যে শুধু কল্পনা নহে, কল্পনার শিল্পরূপও বটে। তাই কল্পনার যুগের বিবর্তন ঘটিয়া মানব যখন শিল্পগুণের হিসেব নিকেশ করিতে শিখিলো, তখনই সাহিত্য যুগের সূচনা ঘটিলো। 


অতঃপর, সাহিত্য আর বিজ্ঞান আপন ছন্দ ধরিয়া চলিতে থাকিলো । কখনো একে অপরের পরিপূরক আবার কখনো একে অপরের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটাইয়া বিস্তার ঘটিতে থাকিলো দুটি উপধারায়। একটি জিজ্ঞাসু চিত্তের মনুষ্য মনে বিজ্ঞানচর্চা প্রবর্তন করিলো আর অন্যটি কল্পদৃষ্টিসম্পন্ন মনুষ্য মনকে শিল্পগুণের বাছ-বিচার করা শিখাইতে লাগিলো। ইহার ফলেই মানব দুটি উপধারায় বিভক্ত হইতে থাকিলো আর বিজ্ঞান এবং সাহিত্য কে একে অপরের অমিত্র রূপে গড়িয়া তুলিলো।  


আধুনিক বিজ্ঞানমনা দৃষ্টি যেরূপে জীবকূলে বিবর্কতনকে বর্ণনা করিয়া চলিয়াছে , ঠিক সেরূপেই বিজ্ঞান দৃষ্টি আর সাহিত্য দৃষ্টিতে ব্যাপক বিবর্তন সাধিত হইতে থাকিলো। বিজ্ঞানচর্চায় ব্যাপকতা আনিতে ইহা বিভক্ত হইতে থাকিলো নানান শাখায়। উদ্ভুত হইলো রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞানের ন্যায় নানান শাখা-উপশাখা। ইহারা যে সবই এককালে একই দৃষ্টিকোণের অন্তর্ভূক্ত আছিলো তাহার প্রমাণ হইলো এই যে, এগুলোর মধ্যে আদ্যকালেও বিভাজন ঘটিয়া চলিয়াছে ।  




বিজ্ঞানের মতো সাহিত্যও বিভাজিত হইতে থাকিলো নানান শাখায়। শাখাসমূহের পারস্পারিক প্রতিযোগিতায় আগাইয়া গিয়াছিলো মঞ্চনাট্য এবং ইহা নানান মনীষীর হাত ধরিয়া বিকশিত হইবার সুযোগও লাভ করিয়াছিলো । ইহার পরে একে একে কাব্য, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস মনুষ্যের শিল্পদৃষ্টির পরিচয় বহন করিতে সক্ষমতা অর্জন করিলে উহারাও বিকশিত হইতে থাকিলো। 



মানব হৃদয়কোণ থাকিয়া যখন প্রকৃতিকে জানিবার অনুসন্ধিৎসু সব জিজ্ঞাসা একে একে উঁকি মারিতে থাকিলো ঠিক তখনই সাহিত্য তৈরি করিলো কাল্পনিক সব প্রকৃতি। বিজ্ঞানের জন্মটা জিজ্ঞাসার দ্বারা হইলেও উহা বিস্তৃত হইয়াছিল কল্পনাতে। বিজ্ঞানের একের পর এক সফলতায় মানব অনুমান করিবার যোগ্যতা লাভ করিয়াছিলো। আপনাকে জিজ্ঞাসা করিবার সাথে সাথেই তাহার একটি সাধারণ উত্তর কল্পনা করিয়া লইতে হয়। হোক তাহা ভুল কিংবা সঠিক। পরবর্তীতে আপনার কল্পনায় সৃষ্ট উত্তরের সহিত সামঞ্জস্য খুঁজিতে থাকিলো পর্যবেক্ষণের। পর্যবেক্ষণ আর আপনার কল্পনা মিলিলেই বিজ্ঞান সফলতার মুখ দেখিলো।



অনেক কালে আবার এমনও ঘটিয়াছে যে, কল্পনা প্রসূত উত্তরসমূহকে হার মানাইয়া সত্য উদ্ঘাটনে বিজ্ঞান চলিয়াছে অদম্য প্রাণশক্তি লয়ে। কাকতালীয় ভাবেও বিজ্ঞান পাইয়াছে অসংখ্য সফলতা। জিজ্ঞাসা ছাড়াও মানব পাইয়াছে নানান উত্তর। 



বিজ্ঞান আর সাহিত্য যে মানব হৃদয়ের নিংড়ানো অনুভূতি তাহাতে কোনো সন্দেহ থাকিবার কথা নহে। তথাপি ইহাদের মধ্যে একইসাথে রহিয়াছে নানান পরিপূরকতা এবং ঘোর সংঘর্ষ। 



বিজ্ঞান আর সাহিত্যের মধ্যে সর্ব গরিষ্ঠ যোগসাজশ হইলো উভয়ই মনুষ্যের অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম এবং সুদৃঢ় সংকল্পের ফসল। বিজ্ঞান যেমন একেকটি সাফল্য অর্জিতে লাখো কাঠ-খড় পুড়াইতেছে ঠিক তেমনই সাহিত্য মানব- মনোরঞ্জনে নিরলস শ্রমদানে নিমিত্ত রহিয়াছে । 



প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানে হালনাগাদ চলিতেছে । বিজ্ঞানই আপনাকে ভুল প্রমাণ করিয়া আপনার জায়গান গাহিয়া চালিতেছে। অপরপক্ষে, সাহিত্য যে বড়ই স্থির। সাহিত্য সাধনায় পরিবর্তনের আঁচড় লাগে, ধীরে ধীরে মনুষ্য-সমাজের সহিত সঙ্গতি রাখিয়া সাহিত্য চলিতেছে সমাজের রথ ধরিয়া। সাহিত্যে আমূল বিপ্লবের খুব কমই দর্শন মিলিয়াছে । কিন্তু বিজ্ঞান এক্ষুনি যাহাকে সত্য বলিয়া চালিয়া যাইতেছে পরক্ষনেই উহাকে ভূল প্রমাণ করিয়া আপনার জাত চিনাইতে ভুল করিবে না।



সাহিত্যের একটি বড়গুণ হইলো ইহা মানবকল্যানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়াছে। সমাজের যাবতীয় অনাচার সমূহকে শিল্পগুণে উপস্থাপন করিয়া মনুষ্য-মনে অনুশোচনার সৃষ্টি করিতে সাহিত্যের বিকল্প কেহ হইবে না। সাহিত্য মানব কে ভালোবাসার পাঠদান করিয়াছে। আন্তঃমনুষ্য দূরত্ব কমাইয়া পৃথিবী কে বাসযোগ্য রাখিতে তৎপর ভূমিকা রাখিয়াছে। অনেকেই মনে করিয়া বসেন যে, সাহিত্যও সমাজে বহুবার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়াছে। ইহা মূলত অজ্ঞতা । যাহা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিবার তরে উদ্ভুত হয় তাহা সাহিত্যের অংশই নহে। সাহিত্য মানব কে অধিকার সচেতন করিয়া তুলিয়াছে বলিয়া এক দল শাসক গোষ্ঠী নিরীহ সাহিত্যবেত্তার উপর ঝাঁপিয়া পড়িয়াছে। শুরু হইয়াছে অনাচার। তথাপি ইহা যে বড়ই সাময়িক। মনুষ্যের মুক্তি অর্জনে ইহা যে অপরিহার্য।ইহা সংগ্রাম, বিশৃঙ্খলা নহে। অন্যদিকে বিজ্ঞান চেষ্টা করিয়াছে মানবজীবন কে সহজ করিতে। মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানের জন্ম হইলেও বহুল অসামাজিক আর অমানবিক কর্মে বিজ্ঞানের লব্ধ জ্ঞান ব্যবহার হইয়া চলিয়াছে।    



বিজ্ঞান যখন জীবকূলে বিবর্তনের কথা বলিতেছে, সাহিত্য তখন মনুষ্য সমাজ লইয়াই ব্যস্ত থাকিতেছে। বিজ্ঞান যখন ভূত-প্রেতের থাকা-না থাকা লইয়া প্রশ্ন তুলিতেছে, সাহিত্য তখন নির্বিঘ্নে ভৌতিক সব আখ্যান রচনায় মগ্ন রহিয়াছে। সাহিত্য যেখানে বলিতেছে সময় প্রবাহনমান, সময় ও স্রোত কাহারও তরে অপেক্ষা করে না; ঠিক তক্ষুনি বিজ্ঞান "টাইম মেশিন" আবিষ্কার করিতে ব্যস্ত। বিজ্ঞান যখন মোমেন্টামকে ভর ও বেগের সমন্বয়ে উদ্ভুত বস্তুর একটি দিকরাশিকে নির্দেশ করিতেছে , ঠিক তখনই সাহিত্য মোমেন্টাম শব্দটিকে জীবনের সামগ্রিক অবস্থা বুঝাইতে ব্যবহার করিতেছে। বিজ্ঞান যখন অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দ কে ঘুম ভাঙানোর কাজে ব্যবহারের পরামর্শ দিতেছে, সাহিত্য তখন মোরগের ডাকে ঘুম থেকে উঠিবার নজির দেখাইতেছে। 



এতো এতো অমিত্রতার পরও বিজ্ঞান আর সাহিত্য যে একে অপরের পরিপূরক তাহা অনস্বীকার্য। সাহিত্য যখন প্রিয়জনের কাছে লিখা চিঠিকে শিল্পগুণে উন্নীত করিতে উৎসাহিত করিতেছে, পরক্ষণেই বিজ্ঞান তাহা প্রিয়জনের নিকট পৌঁছে দিতেছে। সাহিত্য যখন সুস্বপ্ন লইয়া আলোচনা করিতেছে, বিজ্ঞান তখনই স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজিতে উদগ্রীব হইয়া উঠিয়াছে । সাহিত্য যখন ভালোবাসার অনুভূতি লইয়া বর্ণনা করিয়া চলিয়াছে , বিজ্ঞান তখনই আত্মীক আকাঙ্খা সৃষ্টি কে সংজ্ঞায়িত করিতে বিস্তর গবেষণা আরম্ভ করিয়াছে।  



সাহিত্য থাকিয়া জিজ্ঞাসা সৃষ্টির বহু নজীর রহিয়াছে । আবার বিজ্ঞান থাকিয়া কল্পনা সৃষ্টির নজীরও কোনো অংশেই কম নহে।। সাহিত্যের মূল উপজীব্য হইলো কল্পনা। বিজ্ঞানের জয়জয়কার অবস্থায় নতুন নতুন কল্পনার উদ্রেক ঘটাইয়াছে সাহিত্য। আর সেই শৈল্পিক রূপটি বাস্তবে সম্ভব কিনা তাহা যাচাইপূর্বক ফলাফল পাইতে কঠোর অধ্যাবসায় করিয়া চলিয়াছে বিজ্ঞান। 

 

বিজ্ঞান আর সাহিত্যের একীভূতকরণে চেষ্টা চালাইয়া গিয়াছেন একদল মনিষী। সৃষ্টি হইয়াছে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির। বিজ্ঞান সম্মত কিন্তু কল্পনার আশ্রয়ে নির্মিত সব প্রকৃতিতে অবাধ বিরচন করিতে শুরু করিলো মানব। বিজ্ঞান কেও শিল্পগুণে উন্নীত করিয়া জনসম্মুখে উপস্থাপনের প্রয়াস চলিতে থাকিলো। নানান বিবর্তনের পর ইহাও মানব সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। মানুষ ভাবিতে শুরু করিয়াছে। আর এই কল্পকাহিনির সূত্র ধরিয়া একদল মোটা রগের বিজ্ঞানী কল্পকাহিনিতে মগ্ন না হইয়া শুরু করিয়াছেন বিস্তর গবেষণা। কল্পকাহিনির বিষয়টি কি বাস্তবে সম্ভব? ইহার উত্তর হ্যাঁবোধক হইলে আবারও প্রশ্ন তুলিয়াছেন কিভাবে সম্ভব? এভাবে একের পর এক প্রশ্নোত্তরের সমন্বয় সাধন করিয়া কোনো একদিন ইহাকে বাস্তবে রূপায়ন করিতে সক্ষমতা অর্জন করিয়াছেন। 



বিজ্ঞান আর সাহিত্য কে মানব যেভাবে ভাগ করিয়া ফেলিয়াছে তাহাতে দুটিকেই আঁকড়ে ধরিবার পর্যাপ্ত সময় সচারাচর কেহ লভে না । দুটিই যে গভীর, অনন্ত। একজন বিজ্ঞানী যেখানে দৃষ্টির অন্তরালে কোনো কিছু কে স্বীকার করিতে চাহেন না, সাহিত্যিক সেখানেই হৃদয়ের জাল ফেলিয়া শিল্পগুণ খুঁজিয়া চলিয়াছেন। মূলত পার্থক্যটা তৈরি ইহা হইতেই । দুটিকে আলাদা ধারার মনস্তত্ত্ব বিবেচনা করিয়া আদ্যকালে একত্রে ধারণ করিবার সুযোগ যে অপ্রতুল।



মোটা রগের কোনো বিজ্ঞানী সচারাচর সাহিত্য রচনা করিবার সময় পান না। অজানা কে জানিতেই কাটাইয়া দেন পুরোটা সময়। আর ওদিকে একজন সাহিত্যিক নিজের কল্পনাদৃষ্টিকে আরও সুদূরপ্রসারী করিতে চেষ্টা চালাইয়া যাইতে রহিয়াছেন। অব্যাহত চেষ্টায় তাঁহার হৃদয়খানা যে কল্পনাতেই ডুবিয়া রহিয়াছে। বিজ্ঞানচিন্তার সময় কই? 

(রচনাঃ ০৪ নভেম্বর ২০২২ খ্রিঃ)  
(প্রকাশঃ ১৭ নভেম্বর ২০২২ খ্রিঃ)